Padma Jamuna News Agency

সারা বিশ্বে যৌন রোগ সিফিলিস বাড়ছে

সিফিলিস বিশ্বের প্রাচীনতম যৌনরোগের অন্যতম। একসময় মনে করা হয়েছিল এর বিস্তার কমে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই রোগ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

চৌদ্দশ নব্বইয়ের দশকে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করার পর থেকে সিফিলিস রোগকে অনেকগুলো নামে ডাকা হয়েছে যার বেশিরভাগই বেশ অপ্রীতিকর: “ফরাসি রোগ,” “নিয়াপলিটান রোগ,” “পোলিশ রোগ” ইত্যাদি।

কিন্তু সিফিলিসের একটি নাম স্থায়ী রয়ে গেছে: “চরম নকলবাজ।” সিফিলিস অন্যান্য রোগের সংক্রমণকে নকল করতে ওস্তাদ, এবং এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি খুব সহজেই নজর এড়িয়ে যায়। সময়মত চিকিৎসা করা না হলে, সিফিলিসের পরিণতি গুরুতর হতে পারে।

অ্যামস্টারডামের ৩৩-বছর বয়সী প্রজেক্ট অফিসার তুষার দু দু’বার সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে সময় তার যৌন সঙ্গীর কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রথম অসুখের খবর পাওয়ার দিনটির কথা তার খুব মনে আছে।

“সে সত্যিই বিরক্ত হয়েছিল,” বলছেন তিনি। “এই অসুখের জন্য সে আমাকেই দোষারোপ করেছে, যা ‘উইন্ডো পিরিয়ডে’র কারণে একেবারে অসম্ভব। দায়ভার আমার কাঁধে ফেলার বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে এবং তার রাগারাগি কমাতে কিছুটা সময় লেগেছে।”

“পনের বা বিশ বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা সিফিলিস নির্মূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি,” বলেছেন লিয়েন্ড্রো মেনা, সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক।

“কোন সন্দেহ নেই যে এখন আমরা সিফিলিসের বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, এমন এক হারে যেটি আমরা গত ২০ বছরে দেখিনি।”

সিফিলিসের সংক্রমণ যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে তা কিন্তু না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী সিফিলিসের ৭১ লক্ষ নতুন কেস ধরা পড়েছে। ২০২০ সালে ব্রিটেনে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সিফিলিস কেস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সিফিলিস রোগ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দানকারীরা একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করছেন।

“২০০৫ সালে যখন আমি প্রথমবারের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে নার্সিং শুরু করি, তখন প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিস কেস খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই বিরল, এমনকি শহরের কেন্দ্রস্থলের ক্লিনিকেও এটা দেখা যেতো না,” বলছেন ব্রিটেনের এসটিআই ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার জোডি ক্রসম্যান।

এখন ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিস সংক্রমণের হার ৮.৪% বেড়েছে। “এখন বেশিরভাগ শহর-ভিত্তিক ক্লিনিকগুলিতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন রোগীকে সিফিলিস চিকিৎসার জন্য হাজির হতে দেখা যায়।”

ঐ সপ্তাহেই তুষার সিফিলিসের পরীক্ষা করান এবং চিকিৎসা শুরু করেন। “লোকেরা ভুল করে মনে করে যে সিফিলিস এমন একটি রোগ যার কোন চিকিৎসা নেই। শরীরে সিফিলিস অ্যান্টিবডি থাকা এবং সংক্রমণ না থাকার মানে যে কি মানুষ এখনও তা বুঝতেই পারে না।”

সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটে ট্রেপোনেমা প্যালিডাম নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে।

এই রোগের লক্ষণগুলিতে রয়েছে চারটি ধাপ। প্রথম ধাপে নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে এক ধরনের ব্যথাহীন কালশিটে বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এই পর্যায়ে পেনিসিলিন ইনজেকশনের একটি ইন্ট্রামাসকুলার ডোজ সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়।

তবে চিকিৎসা না করা হলে সিফিলিসের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে।

মার্কিন সীমান্তের ওপারে ক্যানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সিফিলিস মহামারি ছড়িয়ে পড়তে দেখেছেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগের চিকিৎসক ও গবেষক আইজ্যাক বোগোচ।

“বিশ্বের একাধিক দেশেই এই প্রবণতাটি দেখা যাচ্ছে,” বলছেন তিনি।

“এটি খুবই উদ্বেগজনক কারণ সিফিলিসের চিকিৎসা করা সাধারণত খুবই সহজ, এবং এর চিকিৎসাও সহজলভ্য।

সুতরাং, এর অনেকটাই ঘটছে নানা দেশে জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোতে বিপর্যয়ের কারণে।”

ক্যানাডায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সিফিলিস রোগের ঘটনা বেড়েছে ৩৮৯%, অন্যান্য যৌন রোগের সংক্রমণের তুলনায় যা অনেক বেশি।

সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিফিলিসের ঘটনা ঘটছে সমকামী, উভকামী এবং অন্যান্য পুরুষদের মধ্যে যারা পুরুষদের সাথে যৌনসংগম করেন।

তবে বিশ্বের কিছু দেশে পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের কেস কমে আসছে। যেমন, ক্যানাডায় পুরুষদের মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের হার কমেছে।

কিন্তু একই সময়ে শুধুমাত্র কানাডায় না সারা বিশ্বেই নারীদের মধ্যে সিফিলিসের হার বেড়েছে। এর ফলে অনেক দেশে এখন কনজেনিটাল সিফিলিসের হার বেড়েছে।

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে ২০২১ সালে মা-থেকে শিশুর মধ্যে সিফিলিসের সংক্রমণের কেস ছিল ৩০,০০০টি। এটি এমন একটি পরিসংখ্যান যা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বর্ণনা করেন ‘খুবই উঁচু’ বলে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহ থেকে অনাগত শিশুর দেহে সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটলে তার পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর: প্রসূতির গর্ভপাত হতে পারে, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অকাল প্রসব ঘটতে পারে, নবজাতকের জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে এবং জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগত সিফিলিসের হার এখন বাড়ছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সিফিলিসের কেস বেড়েছে ৩.৫ গুণ। ২০২১ সালে এই হার আরও বেড়েছে, যার ফলে ঐ বছর ২২০ টি মৃত-প্রসব এবং শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের এসব পরিসংখ্যানের মধ্যে দেশের ভেতরে কোন কোন জায়গায় কিছু নাটকীয় ঘটনা লুকিয়ে থাকে।

যেমন, মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের ডাক্তাররা গত পাঁচ বছরে জন্মগত সিফিলিসের ঘটনা ৯০০% বেড়েছে বলে জানিয়েছেন।

আর এসব ঘটনা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ঘটছে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং হিস্প্যানিক নারীদের মধ্যে।

উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে মার্শফিল্ড ক্লিনিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহযোগী গবেষণা বিজ্ঞানী মারিয়া সুন্দরম বলছেন, “আমাদের জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা পরিকাঠামোতে যে অন্তর্নিহিত বৈষম্য এবং বর্ণবাদ রয়েছে এসব ঘটনায় সেটাই প্রতিফলিত হয়।”

নারীদের সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠী, যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন কিংবা মাদক নেশার সাথে লড়ছেন, তারাই সিফিলিস রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।

আর বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি এই বৈষম্যগুলিকে অনেকগুলি বাড়িয়ে দিয়েছে।

“জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা একমত যে সিফিলিস-সহ বিভিন্ন যৌন রোগ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্ভবত কোভিড মহামারি চলার সময় এসটিআই প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলির কাজে ব্যাঘাতের একটা সম্পর্ক রয়েছে,” বলছেন মিজ সুন্দরম।

সিফিলিস রোগের মহামারির পেছনে যেসব সমস্যা কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো: যৌনরোগ পরীক্ষা কেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়ে সমস্যা, সিফিলিসকে ঘিরে লজ্জা এবং সামাজিক কলঙ্ক, এবং সম্ভবত ভাষাগত বাধা।

ব্রাজিলের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্কুলে যাননি এমন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মধ্যে জন্মগত সিফিলিসের হার অনেক বেশি।

অনেক ক্ষেত্রেই, সিফিলিস স্ক্রিনিং করে এমন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যায় পড়তে হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ন কাউন্টির আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কনজেনিটাল সিফিলিসের সংক্রমণ নির্ভর করছে নারীদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স, এবং গর্ভবতী মহিলাদের ওপর যৌন সহিংসতা কিংবা বাড়িতে সহিংসতার ওপর। এসব নারীদের মধ্যে অর্ধেকই হলেন হিস্প্যানিক, লাতিনো কিংবা স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত।

অস্ট্রেলিয়ায় ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সিফিলিসের হার ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৯০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *